বিখ্যাত দার্শনিক ভল্টেয়ার বলেছিলেন- ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। মেরুদন্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না তেমনি শিক্ষাহীন জাতিও সোজ...
বিখ্যাত দার্শনিক ভল্টেয়ার বলেছিলেন- ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। মেরুদন্ডহীন মানুষ যেমন সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না তেমনি শিক্ষাহীন জাতিও সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না অর্থাৎ টিকে থাকতে পারে না।শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে নেপোলিয়ন বলেছিলেন- ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদেরকে একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।কথাগুলির ওজন অনেক বেশি। শিক্ষাহীন জাতির ধ্বংস অনিবার্য। মানুষের জ্ঞান ও চিত্তের উৎকর্ষের জন্য, মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য, চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধের জন্য, সর্বোপরি মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান নিয়ামক। শিক্ষা মানুষের চিন্তা ও মননকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, জ্ঞানী করে। জ্ঞানকে সুপ্রয়োগ করলে তা হয় বিজ্ঞতা। বিজ্ঞতা সাফল্য নিশ্চিত করে। বিখ্যাত চীনা দার্শনিক কুয়ানৎসু বলেছিলেন ‘যদি এক বছরের পরিকল্পনা মতো ফল পেতে চাও শস্য রোপণ কর, যদি দশকের ফল পেতে চাও বৃক্ষ রোপণ কর, যদি সমগ্র জীবনের জন্য পরিকল্পনা করে ফল পেতে চাও তবে মানুষের সুশিক্ষার ব্যবস্থা কর।’
শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অনেকেই অনেক কথাই বলতে পারেন। শিক্ষা মানব জীবনের উন্নয়ন ঘটায়, মনুষত্বের বিকাশ ঘটায়। চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করে, মূল্যবোধ জাগ্রত করে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কথাগুলি সবই সত্য।কিন্তু আমার বিশ্বাস বর্তমান প্রজন্ম এইসব গুনাবলী অর্জনের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করে না।এমন একজনও ছাত্র বা ছাত্রী খুজে পাওয়া যাবে না যার মুখ থেকে শোনা যেতে পারে যে সে শুধুমাত্র চাকরী বাকরীর জন্য লেখাপড়া করছে না।শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের জন্য, চারিত্রিক গুনাবলী বিকশিত করার জন্য বা মূল্যবোধ জাগ্রত করার জন্য লেখাপড়া করছে এমন ছাত্র ছাত্রী সমাজে নেই বললেই চলে। অথচ ভল্টেয়ার, নেপোলিয়ন বা কুয়ানৎস এমন শিক্ষার কথাই বলেছিলেন।মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে কিন্তু চরিত্র গঠন ও মানবীয় মূল্যবোধ কি জাগ্রত হচ্ছে? বা দক্ষ মানব সম্পদ কি আসলেই তৈরি হচ্ছে? দার্শনিকরা শিক্ষার যে উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন সেই উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না।তাহলে বর্তমান প্রজন্ম যে উদ্দেশ্য নিয়ে লেখাপড়া করছে সেই উদ্দেশ্য কি পূরণ হচ্ছে? আমাদের বিশাল বেকার জনগোষ্ঠি বলছে যে সেই উদ্দেশ্যও সঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না। তাহলে আমরা লেখাপড়া করছি কেন? শিক্ষিত হচ্ছি কেন?
আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে। সেসকল বিষয়ে যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা যে আমাদের স্বপ্নগুলির অপমৃত্যুর জন্য দায়ী এবং জাতীয় উন্নয়নের পথে অন্তরায় সে প্রসঙ্গে দুটি কথা বলতে চাই। একজন শিশু যখন তার শিক্ষা জীবন শুরু করে তখন থেকেই সে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, বিচারক, শিক্ষক, সাংবাদিক ইত্যাদি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে, মাধ্যমিক শেষ করে। এক সময় সে উচ্চ মাধ্যমিকও শেষ করে।তারপর শুরু হয় তার সেই স্বপ্নের প্রথম সিড়িতে পা দেওয়ার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা। শুরু হয় ভর্তি যুদ্ধ। মুষ্টিমেয় কিছু ছাত্র ছাত্রী তাদের স্বপ্নের প্রথম সিড়িতে পা রাখতে পারলেও অধিকাংশই পা পিছলে পড়ে যায়।পছন্দের বিষয় বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ হয়না অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রীর। তাদের প্রথম স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে। ফলে বাধ্য হয়ে পড়তে হয় পছন্দের বাইরের বিষয় নিয়ে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জীবন হয়ে যায় নিরস। পড়াশুনার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। আপনাকে যদি আপনার পছন্দের পাত্র বা পাত্রীর সাথে বিয়ে দিয়ে অপরিচিত কারও সাথে বিয়ে দেয়া হয় তাহলে আপনার দাম্পত্য জীবনটা যেমন নিরান্দময় হবে তেমনি যদি আপনার পছন্দের বিষয় নিয়ে আপনাকে পড়তে দেয়া না হয় ছাত্র জীবনও তেমন নিরানন্দময় হবে। পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়তে না পারলে পড়াশুনার প্রতি আপনার আগ্রহ কমে যাবে। আপনার মেধার সঠিক বিকাশ হবে না। ফলে জাতি আপনার মেধার কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে।
পছন্দ বা অপছন্দের বিষয়ে ভর্তি হওয়ার পর শুরু হয় ভাল একটা চাকরী পাওয়ার স্বপ্ন। লেখাপড়া শেষ করার পর শুরু হয় চাকরী পাওয়ার জন্য আরেক যুদ্ধ।চাকরী নামের সোনার হরিণ পাওয়াটা সহজ বিষয় নয়। এই যুদ্ধে হেরে গিয়ে অনেক তরুণ তরুণী বিপথে যায়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আত্মহনণের পথ বেছে নেয়। অনেকেই চাকরীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে পছন্দের বা অপছন্দের একটি চাকরী পায়। পছন্দসই চাকরী হলে সমস্যা নেই। কিন্তু অপছন্দসই চাকরী হলেই বিপত্তি। পছন্দসই চাকরী না পাওয়ায় একজন তরুণের আরেকটি স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটে। নিরান্দময় চাকরী নিয়ে কাজ চালানো যায় কিন্তু জাতিকে ভাল কিছু দেয়া সম্ভব হয় না। মেধার সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। কারণ চাকরীতে তো কোন আগ্রহ নেই। শুধু চাকরী বাচানোর জন্য চাকরী করা আর কি! কিন্তু এই চাকরী পাওয়া তরুণের সংখ্যাই বা কত? অধিকাংশ তরুণ তরুণীরই বেকার থেকে যায়। ফলে এখানেও জাতি বিশাল একটি জনগোষ্টীর মেধা থেকে বঞ্চিত হয় যা জাতীয় উন্নয়নের পথে বিরাট অন্তরায়।কারগরী শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে বরং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি জোর দেওয়ায় সম্ভবত বেকারত্বের জন্য দায়ী।
আমরা অনেক ক্ষেত্রেই উন্নতি করেছি, কিন্তু কেন সেই উন্নয়ন–প্রক্রিয়ায় তরুণদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না, সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকেরা একেবারেই উদাসীন বলে মনে হচ্ছে। যথা বাংলাদেশে নিষ্ক্রিয় তরুণদের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, তরুণেরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাঁদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি হওয়া ব্যক্তি ও পরিবার তো বেটেই, রাষ্ট্রেরও বিরাট অপচয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে বেকার ছিল ২৬ লাখ ৭৭ হাজার; যা আগের বছরের চেয়ে ৮৭ হাজার বেশি। দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৫ লাখ হলেও এদের একটি বড় অংশ যে পুরোপুরি বেকার অথবা ছদ্মবেশী বেকার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। (সুত্র: প্রথম আলো)
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেয়াটা এখন সময়ের দাবি। যদি আমরা কারিগরি শিক্ষার দিকে বেশি ধাবিত হই তবে তা বাংলাদেশের বেকার সমস্যা সমাধানে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়। কারণ কারিগরি শিক্ষা একদিকে যেমন শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা বাড়িয়ে তাকে আরো মেধাবী করে তুলতে পারে অপরদিকে একটা নতুন আবিষ্কার হয়ে উঠতে পারে দেশের সম্পদ এবং একই সঙ্গে যা ভূমিকা রাখবে দেশের বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে। যদি আমরা স্বনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে চাই তবে আমাদের তত্ত্বগত শিক্ষার জড়তা কাটিয়ে উঠতে এবং একই সঙ্গে নিজেদের মেধাকে যথাযথ অবস্থায় তুলে ধরতে প্রয়োজন কারিগরি শিক্ষার প্রসারতা।
পোস্টটি লিখেছেন-এডভোকেট আজাদী আকাশ।
সুপ্রিয় পাঠক, পোস্টটি সম্পর্কে আপনার কোন মতামত থাকলে নিচে মন্তব্যের ঘরে জানাতে পারেন। এছাড়া আমাদের ব্লগে লিখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন।
COMMENTS